আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির তিনজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বলেছেন, সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন—সমাবেশে ঘোষণা দিয়ে এই দাবি অর্জন সম্ভব নয়। এমনকি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন করার বিষয়টি আলোচনার টেবিলেও আনতে রাজি নন তাঁরা। কারণ, বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোতে তা সম্ভব নয়। ফলে বিএনপিকে দাবি আদায় করতে হলে শক্তি দিয়ে বাধ্য করতে হবে সরকারকে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপির পক্ষে তা করা সম্ভব হবে না।
পদত্যাগের খবরে স্পিকারের বিস্ময়, বললেন বিএনপির রুমিন ফারহানা

বিএনপির সরকারবিরোধী এক দফার আন্দোলনের বিষয়টি মাথায় রেখে এই মুহূর্তে তিনটি অগ্রাধিকার ঠিক করেছে আওয়ামী লীগ। প্রথমত, দলের সব পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের নির্বাচনমুখী করে ভোটের জন্য প্রস্তুত করা। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের চেষ্টা জোরদার করা। তৃতীয়ত, সরকার সম্পর্কে পশ্চিমা শক্তিগুলোর মধ্যে কিছু নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়ানো।
গুজবের জবাব, অর্জনের প্রচার
আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, আগামী নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ চান তাঁরা। বিএনপিকে ভোটে আনতে তাদের কিছু দাবিদাওয়া নির্বাচনের আগে বিবেচনায় নেওয়া হবে। তবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার ও সরকারের পদত্যাগ—এই দুটির বিষয়ে কোনো ছাড় নয়। আর নির্বাচন বর্জনের পথে গেলে বিএনপির ভেতর ভাঙন ধরানোর চেষ্টাও থাকবে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, বিএনপির বর্তমান মাঠের শক্তির সঙ্গে প্রভাবশালী কয়েকটি রাষ্ট্রের চাপ কিছুটা বেকায়দায় ফেলেছে সরকারকে। প্রাথমিকভাবে পশ্চিমা দেশগুলোর সমালোচনার জবাব কড়া ভাষায় ফিরিয়ে দিতে চায় আওয়ামী লীগ। কিন্তু সমালোচনার মাধ্যমে এই চাপ থেকে বের হওয়া যাবে না। তাই কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করাই মূল লক্ষ্য।
তবে বিএনপির চেয়েও দেশের বর্তমানে অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে বড় সমস্যা বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা। তাঁদের মত হচ্ছে, দেশের অর্থনীতি আগের জায়গায় ফিরে এলে বিএনপি কিংবা বিদেশি শক্তি কেউ সরকারকে চাপে ফেলতে পারবে না। কিন্তু সংকট না কাটলে বিএনপি আরও চাপ বাড়াতে চাইবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দাবির সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এ জন্য তারা তাদের সমাবেশে সেভাবে সাড়া পায়নি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিএনপিরও ভোটের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। ১০ দফার মতো অলীক দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমে সুবিধা করতে পারবে না।
১০ ডিসেম্বর ঘিরে বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ে অভিযান ও দলটির নেতাদের গ্রেপ্তার—গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহে নিজেদের বড় কোনো লোকসান দেখছে না আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা মনে করছেন, বিএনপির নেতাদের গ্রেপ্তার ও নয়াপল্টনে অভিযান নিয়ে দেশে-বিদেশে কিছু সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু বাধা ছাড়াই শেষ পর্যন্ত দলটিকে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে দেওয়ায় সে সমালোচনা কিছুটা হলেও কমেছে।
লাভের বিষয়টি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, গত ১৪ বছর টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে একধরনের শৈথিল্য সৃষ্টি হয়েছিল। দলের ভেতরে দ্বন্দ্ব-সংঘাতও প্রকট। বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ শুরুর পর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিভেদ ভুলে রাজপথে সক্রিয় করা গেছে। এটা বড় অর্জন। অর্থাৎ প্রতিপক্ষ চাপ দেওয়ার পর দলের কর্মীরা গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছেন।
আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপে বিএনপি
বিএনপির সাতজন চলে গেলে সংসদ অচল হবে না: ওবায়দুল কাদের

পদত্যাগে বড় ক্ষতি দেখছে না আ.লীগ
বিএনপির সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ করতে পারেন—এমন ধারণা আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে আগে থেকেই ছিল। নিজেদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং জাতীয় পার্টি (জাপা) সংসদে এখনো থাকায় বিএনপির সদস্যদের পদত্যাগে বড় ক্ষতি দেখছেন না আওয়ামী লীগের নেতারা। তবে দলের নেতাদের মধ্যে এমন আলোচনা আছে, বিএনপির সদস্যদের পদত্যাগের বিষয়টি পশ্চিমা বিশ্বে হয়তো একটা ‘ইস্যু’ হিসেবে দেখা হবে। এ ছাড়া বিএনপির সংসদ সদস্যদের পদত্যাগের ফলে সরকারের সঙ্গে জাপার দর-কষাকষির ক্ষমতা বেড়ে যাবে। এমন পরিস্থিতিতে সংসদে বিরোধী দলের নেতা হওয়ার যে আবেদন করেছেন জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের, সেটি বিবেচনায় নিতে সরকারের ওপর চাপ বাড়াবে। বর্তমান সংসদের শুরু থেকেই বিরোধী দলের নেতার পদে আছেন জাপার ‘প্রধান পৃষ্ঠপোষক’ রওশন এরশাদ।
সংসদ সদস্যদের পদত্যাগের কারণে বিএনপিরই বেশি ক্ষতি হবে বলে মনে করছে আওয়ামী লীগ। দলীয় সূত্র বলছে, বিএনপিকে নির্বাচনে আনার বিষয়ে ছাড়ের অংশ হিসেবে দলটির কাউকে নির্বাচনকালীন সরকারে স্থান দেওয়ার পরিকল্পনা আছে। এখন সংসদ থেকে পদত্যাগের ফলে সে সম্ভাবনা কমে গেছে। এ ছাড়া সংসদে বিএনপির সংসদ সদস্যদের কথা বলার সুযোগ বেশি দেওয়া হতো। তাঁরা এই সুযোগ নিয়ে চার বছর ধরে সরকারের কঠোর সমালোচনা করে আসছিলেন। গণমাধ্যমে তাঁদের বক্তব্য গুরুত্ব দিয়ে প্রচার হতো। পদত্যাগের মাধ্যমে সেই সুযোগ হারাল বিএনপি।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি যে ১০ দফা দিয়েছে, এর সব কটি মানুষ পড়েও দেখবে না। অতীতে তারা নানা সময় বিভিন্ন দাবি নিয়ে মাঠ গরম করেও শেষ পর্যন্ত কিছু করতে পারেনি। আর সরকার বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় ব্যস্ত। এসব দাবি নিয়ে ভাবারও সময় কম।
বিএনপির সংসদ সদস্যদের পদত্যাগ সম্পর্কে মতিয়া চৌধুরী বলেন, তাদের লাভ-ক্ষতি তারা হিসাব করুক। আওয়ামী লীগের এসব নিয়ে এত মাথা ঘামানোর প্রয়োজন নেই।